পরিবার, পাপ ও প্রায়শ্চিত্তের গল্প (2025)

তিন বছর পর পর্দায় ফিরলেন নির্মাতা সৈয়দ আহমেদ শাওকী। ফেরাটা হলো জটিল, আবেগঘন আর রহস্যে মোড়া এক গল্প দিয়ে। গত বুধবার রাতে মুক্তি পাওয়া চরকি অরিজিনাল সিরিজ ‘গুলমোহর’ যেন একটি পরিবারের আয়নায় সমাজের আড়ালে থাকা অনেক গোপন ও গভীর সত্যকে তুলে ধরেছে। আট পর্বের এই সিরিজ মুক্তির পর থেকেই দর্শকের কৌতূহল বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু একটি পরিবারের দ্বন্দ্ব নয়, সিরিজটিতে উঠে এসেছে অতীতের পাপ, তার প্রায়শ্চিত্ত এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।

বাড়ির নামেই গল্প
‘গুলমোহর’ শুধু একটি নাম নয়, এটি একটি বাড়ি, একটি পরিবারের ইতিহাস, সম্পর্কের বন্ধন, আবার বিচ্ছেদও। বাহ্যিকভাবে জমিজমার ভাগাভাগি, অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন, ভাই–বোনের সম্পর্কের টানাপোড়েন—সবই দেখা যায় সিরিজে। কিন্তু শাওকীর নির্মাণ দর্শককে এর অনেক গভীরে নিয়ে যায়। সেখানে আছে দীর্ঘদিন ধরে চেপে রাখা পাপ, আছে পূর্বপুরুষের ভুলের ভার বর্তমান প্রজন্মের ঘাড়ে চেপে বসা যন্ত্রণা। সিরিজের গল্প শুরু হয় একটি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। পিতার মৃত্যুতে একত্র হয় পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু তাৎক্ষণিক শোকের ভেতর থেকেই যেন ফাটল ধরতে শুরু করে সম্পর্কের দেয়ালে। উত্তরাধিকারের লড়াই, পুরোনো অভিমান, গোপন অপহরণ, এমনকি রাজনৈতিক প্রভাব—সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক গভীর সংকট। নির্মাতা শাওকী বলেন, ‘এটা ঠিক, গল্প রহস্যধর্মী ঢঙে বলা হলেও এটা আসলে এক মানসিক যাত্রা। আমি রহস্যের ভেতর দিয়ে গল্প বলাটা উপভোগ করি, এটা আমার শক্তির জায়গা।’

গুলমোহরের দাবিদারেরা
সিরিজটিতে অভিনয় করেছেন ভারতীয় অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। তিনি যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তাকে নির্মাতা ব্যাখ্যা করেছেন গল্পের প্রয়োজনেই বিতাড়িত এক মানুষ হিসেবে, যে কিনা সমাজচ্যুত হয়েও নির্দিষ্ট একটি উদ্দেশ্যে ফেরে গল্পে। তার পারফরম্যান্স একদিকে ভারী, অন্যদিকে সংবেদনশীল। শাওকীর ভাষ্যে, ‘আমি সমাজচ্যুত মানুষের চোখ দিয়ে গল্প বলতে পছন্দ করি। শাশ্বতের চরিত্রে আমি সেই ভালো লাগার কাজটাই করেছি।’

সিরিজটি মুক্তি উপলক্ষে গত মঙ্গলবার ঢাকার সাংবাদিকদের সঙ্গে এক ভার্চ্যুয়াল আড্ডায় যুক্ত হন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা থেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রথমবার বাংলাদেশে আসার অভিজ্ঞতা, ‘গুলমোহর’–এ কাজের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি। শাশ্বত বলেন, ‘খুবই সুন্দর একটা বিষয়। এমন গল্প আমাদের এখানে খুব একটা হয় না। পুরোনো পারিবারিক ঐতিহ্য, ব্যাকগ্রাউন্ড—সব মিলে অন্য রকম অভিজ্ঞতা।’

ঢাকার শিল্পীদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে শাশ্বত বলেন, ‘এত বড় বড় সব নাম (অভিনয়শিল্পী) আছে। আমি একটু গুটিয়েই ছিলাম। কিন্তু বাকিরা এত সুন্দরভাবে আমাকে গ্রহণ করেছেন। কাজ করতে গিয়ে একবারও মনে হয়নি দেশের বাইরে কাজ করছি। আমার মনে হচ্ছে আমি কলকাতার বাইরে শুট করছি।’ এবারই প্রথমবার বাংলাদেশে এসেছিলেন এই অভিনেতা। তিনি বলেন, ‘আমি এই প্রথম বাংলাদেশে পদার্পণ করলাম। সেটা নতুন অভিজ্ঞতা ছিল আমার কাছে। আমাদের ছোটবেলায় অ্যান্টেনার সঙ্গে বুস্টার লাগালে বিটিভি দেখা যেত। বাংলাদেশে টেলিনাটকের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। বাংলাদেশের টেলিভিশনে খুব সুন্দর সুন্দর নাটক হতো। সেগুলো দেখতাম।’

সিরিজে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন দেশের জ্যেষ্ঠ অভিনেত্রী সারা যাকের। ভাই–বোনের ভূমিকায় আছেন ইন্তেখাব দিনার, সুষমা সরকার ও মীর নওফেল আশরাফী জিসান। সিরিজটি নিয়ে সুষমা সরকার বলেন, ‘এটি আমার অভিনয়জীবনের এক অনন্য সংযোজন। মহড়া থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়াটা ছিল দুর্দান্ত। রেহনুমা বা রেনু এমন একটা চরিত্র, যাকে দেখলে মনে হবে এ তো খুবই পরিচিত একটা চরিত্র; আবার কোথায় গিয়ে যেন সে একটু অপরিচিত হয়ে ওঠে। যে বারবার খোঁজে তার পারিবারিক সম্পর্কের সুর।’ রবি চরিত্রে অভিনয় করেছেন আলোচিত তরুণ অভিনেতা মীর নওফেল আশরাফী জিসান। তাঁর ভাষ্যে, ‘এখানে অন্য সবার সঙ্গে আমাকে যেন পরিবারের সদস্য বলেই মনে হয়, অভিনয়ে-উপস্থিতিতে সেই চেষ্টাই ছিল আমার।’ নীরবতাও যে একটি ভাষা, সেটাই সিরিজে ফুটিয়ে তুলেছে শান্তা চরিত্রটি। এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন সারিকা সাবাহ। তিনি তাঁর চরিত্র নিয়ে বলেন, ‘এ চরিত্রটির কাছে যেন কষ্টটাই সাবলীল আর ভালোবাসাটাই বোঝা। আমার মনে হয়, অনেকেই তাদের নিজেকে শান্তা চরিত্রের মধ্যে দেখতে পাবেন।’ বাবা, স্বামী, সন্তান, ভাই এবং রাজনৈতিক নেতা—নানা মাত্রার চরিত্র রানার। এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোস্তাফিজুর নূর ইমরান। অভিনেতা বলেন, ‘এ চরিত্রটির কাছে উত্তরাধিকার এবং এর পরম্পরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খুবই চাপা স্বভাবের, নিজের ভাবনা বা পরিকল্পনা অন্যদের জানায় না এবং নিজের মধ্যেই তিলে তিলে শেষ হয়।’

সুরের ছন্দে গল্পের কাঠামো
সিরিজের একটি চমকপ্রদ দিক হলো এর পর্বগুলোর নামকরণ। সংগীতের সাতটি স্বর—সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি, সা—এই স্বর নিয়েই সাজানো হয়েছে সিরিজের পর্বগুলো। একে একে গল্প এগোতে থাকে সুরের মতোই। এক জায়গায় গিয়ে সেই সুর হারিয়ে যায়, আবার কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় হারানো ছন্দ। নির্মাতার ভাষ্যে সংসারে শান্তি বজায় রাখতে পরিবারে প্রয়োজন হয় একরকম সুরের, ছন্দের। গুলমোহর-এর সেই ছন্দ ভেঙে গিয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো, সেটা কি আর ফিরে আসবে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই দর্শককে দেখতে হবে পুরো সিরিজটি।

‘গুলমোহর’ শাওকীর তৃতীয় ওয়েব সিরিজ হলেও চরকির সঙ্গে এটি তাঁর প্রথম কাজ নির্মাতা হিসেবে। এর আগে তিনি প্ল্যাটফর্মটির সঙ্গে প্রোডাকশন ডিজাইনার ও এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার হিসেবে কাজ করেছেন। সিরিজটিকে তিনি বলছেন, ‘নির্মাতা হিসেবে এটি আমার সবচেয়ে বড় স্কেলের কাজ। গল্পটা নিয়ে কাজ করার জন্য সময় দরকার ছিল। এখন মনে হচ্ছে, অপেক্ষাটা সার্থক।’

আরও পড়ুন

শাওকীর সিরিজে শাশ্বত, কবে আসছে ‘গুলমোহর’০৬ মে ২০২৫

এই সিরিজের গল্প, সংলাপ ও চিত্রনাট্যে শাওকীর সঙ্গে ছিলেন মারুফ প্রতীক। দুজনের যৌথ লেখনীতে গড়ে উঠেছে এমন এক পারিবারিক রহস্যনাট্য, যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনের চেনা কাঠামোর মধ্যেই প্রশ্ন তোলে—আমরা কি সত্যিই আমাদের পরিবারের ইতিহাস জানি?

পরিবার, পাপ ও প্রায়শ্চিত্তের গল্প (2025)
Top Articles
Latest Posts
Recommended Articles
Article information

Author: Virgilio Hermann JD

Last Updated:

Views: 5986

Rating: 4 / 5 (41 voted)

Reviews: 80% of readers found this page helpful

Author information

Name: Virgilio Hermann JD

Birthday: 1997-12-21

Address: 6946 Schoen Cove, Sipesshire, MO 55944

Phone: +3763365785260

Job: Accounting Engineer

Hobby: Web surfing, Rafting, Dowsing, Stand-up comedy, Ghost hunting, Swimming, Amateur radio

Introduction: My name is Virgilio Hermann JD, I am a fine, gifted, beautiful, encouraging, kind, talented, zealous person who loves writing and wants to share my knowledge and understanding with you.